শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৩০ পূর্বাহ্ন
প্রদীপ সাহা:
আমাদের পৃথিবী ডুবে আছে এক বিরাট বায়ুসমুদ্রে। বায়ুমণ্ডলের গড় অবস্থা হচ্ছে জলবায়ু। অর্থাৎ বায়ুর গড় তাপ, আর্দ্রতা, প্রবাহ এসব মিলেই হলো জলবায়ু। জলবায়ুর প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে তাপ। পৃথিবীতে এ তাপশক্তির মূল উৎসই হলো সূর্য। কিন্তু বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে জলবায়ুর নজিরবিহীন পরিবর্তন ঘটে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী অন্যতম একটি আলোচিত বিষয় হচ্ছে ক্লাইমেট চেঞ্জ অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তন। প্রশ্ন হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী কে? পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমন করছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র, যা প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ। এর পরেই আসছে রাশিয়া, ভারত, জার্মানি, ব্রাজিল ও অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশ। জনসংখ্যার বিচারে সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমন করছে অস্ট্রেলিয়া। সে তুলনায় বাংলাদেশে কার্বন নির্গমনের হার অত্যন্ত কম, শতকরা প্রায় শূন্য দশমিক ২ ভাগ মাত্র। এতে বোঝা যায়, উন্নত ও দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলো পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে দায়ী। অথচ দেখা যাচ্ছে, জলবায়ুর এ পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উন্নত বিশ্বের এগিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন।
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। এখানে বন্যা, আকস্মিক বন্যা, ঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ও লবণাক্ততা ইত্যাদির মাত্রা বেড়ে যাবে। উত্তরাঞ্চলে খরা ও মরু প্রবণতা দেখা দেবে এবং দক্ষিণাঞ্চলে ঝড় ও সাইক্লোনের প্রকোপ বাড়বে। সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফীত হলে বাংলাদেশের নদী-মোহনা ও উপকূলীয় অঞ্চলের লোকদের ওপর নেমে আসবে বিপর্যয়। শত শত বর্গকিলোমিটার উপকূলীয় ও অন্যান্য নিম্নাঞ্চল অধিক মাত্রায় প্লাবিত হবে। বন্যার ব্যাপকতায় মানুষের জীবনধারণ, কৃষি, গবাদিপশু, দালানকোঠা ও ভৌত কাঠামোসহ ব্যাপক হুমকির সম্মুখীন হবে। যার প্রমাণ বিগত বছরগুলোর ভয়াবহ বন্যা, ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা। এ বছর (২০২২) সিলেট অঞ্চলের ভয়াবহ বন্যাও এর আরেকটি প্রমাণ। উজানে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে সিলেট, সুনামগঞ্জ এবং উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলাসহ বিভিন্ন এলাকা এবার আকস্মিকভাবে বন্যাকবলিত হয়েছে। অন্যদিকে, উজানের পানি একতরফাভাবে ভারত আটকে রাখার ফলে প্রমত্ত পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র এবং তিস্তার মতো নদীগুলো এখন মৃতপ্রায়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানি সংকটের কারণে যেমন বিভিন্ন এলাকা বা অঞ্চল মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি উজানের পানির ঢলে আকস্মিক বন্যা দেখা যাচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন নিঃসন্দেহে এ অবস্থাকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাবে।
আইপিসিসি-র সর্বশেষ গবেষণা থেকে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ বর্তমান সময়ের তুলনায় বার্ষিক গড় তাপমাত্রা বাড়বে ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বর্ষাকালে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির তুলনায় শীতকালে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার হবে বেশি। শীতের তীব্রতা অনেকটাই কমে যাবে, কিন্তু গ্রীষ্মকালে গরমের মাত্রা ক্রমেই বাড়বে। এতে দেশে ছয়টি ঋতুর পরিবর্তে কেবল চারটি ঋতু আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যাবে। বিশ্বব্যাংকের এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ বাসস্থান হারাবেন। ১ কোটি মানুষ এরই মধ্যে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছেন। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীর পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীভাঙ্গন এবং ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতিবছর ৪ লাখ মানুষ স্থায়ীভাবে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছেন। এদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগই জলবায়ু উদ্বাস্তু।
দ্রুত শিল্পায়ন ও শক্তির ব্যবহার আজ অপরিহার্য। কিন্তু এর ফলে সৃষ্ট জলবায়ুর পরির্তন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফীতির কারণে সারা বিশ্ব আজ চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। বিজ্ঞানীদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ুর পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফীত হওয়ার প্রতিক্রিয়া আরও ভয়াবহ হতে পারে। তবু তারা আশাবাদী, যথাযথ ব্যবস্থা ও কর্মসূচি গ্রহণ করলে পরিস্থিতি আয়ত্তের মধ্যে রাখা সম্ভব হতে পারে। আর এ ভয়াবহ পরিণাম থেকে বাঁচতে হলে আমাদের বিদ্যুৎ এবং সব ধরনের জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন, পরিবহন ও ব্যবহারে অপচয় রোধ করতে হবে এবং দক্ষতা বাড়াতে হবে। সৌর ও অন্যান্য শক্তি এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। ধানক্ষেতে সেচের ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে, যাতে মিথেন গ্যাস কম নির্গত হয়। কলকারখানায় জ্বালানি সাশ্রয়ের লক্ষ্যে প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়াতে হবে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গৃহস্থালী ও শিল্প-কারখানার আবর্জনা প্রক্রিয়াজাত করতে হবে। সর্বোপরি অধিক হারে বনায়ন বাড়াতে হবে এবং বন উজাড়ের প্রবণতা রোধ করতে হবে।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রতি বছরে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ওঠে এমন দিনের সংখ্যা আশির দশকের তুলনায় বর্তমানে দ্বিগুণ বাড়ছে। ১৯৮০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে ১৪ দিন তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করেছে। ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল বছরে ২৬ দিন। সম্প্রতি (১৫ জুলাই ২০২২) যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাপপ্রবাহের একটি মাত্রাচিত্র প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, ওইদিন দুপুরে স্পেনের সেভেলি শহরের তাপমাত্রা উঠেছে ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ইরানের আহভাজ শহরের তাপমাত্রা উঠেছে ৪৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং চীনের সাংহাই শহরের তাপমাত্রা উঠেছে ৩৭ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ বড় শহরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪৫ থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। অন্যদিকে, আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে (১৬ জুলাই), আমাদের দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল নীলফামারীর সৈয়দপুরে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের বেশিরভাগ জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে (১৫ জুলাই), ভারতের বেশিরভাগ শহরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। সহজেই বুঝতে পারছি, কী এক কঠিন পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে আমাদের সামনে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আজ আমরা পরিবেশ এবং প্রকৃতির যে ভয়াবহ রূপ ও পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করছি, যেভাবে দিন দিন অসহনীয়ভাবে বেড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা, আকস্মিক বন্যা- তাতে উদ্বিগ্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এ অবস্থায় জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। বাঁচাতে হবে বিপন্ন এ পৃথিবীকে। আসুন, আমরা সবাই মিলে সুন্দর এ পৃথিবীটাকে রক্ষা করি এবং বাসযোগ্য করে তুলি।
লেখক: কলামিস্ট
ভয়েস/জেইউ।